নিজস্ব প্রতিবেদক :
‘নিজ মুখে নিজ ক্যাম্পাসের ভয়াল বিভীষিকাময় ঘটনার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে আজ আমি ঢাবিয়ান বলতেই এক অসামান্য লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছি। আমার পায়ের জুতা দিয়ে পিষে দেয়ায় আমার নখ উঠে গেসে। ব্লিডিং হচ্ছিল।’
ওপরের এই কথাগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত এক ছাত্রীর।
শনিবার বিকাল পৌনে ৬টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে ছাত্রলীগের কনিষ্ঠ কর্মীদের যৌন নিপীড়ন ও মারধরের ঘটনার শিকার হয়েছেন তিনি। তার সঙ্গে থাকা সহপাঠী আসাদুজ্জামান প্রান্তকেও বেধড়ক মারধর করা হয়েছে।
ঘটনার পর নির্যাতিত ছাত্রী সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশিত এক স্ট্যাটাসে তার ওপর পরিচালিত নির্যাতনের বিবরণ দিয়েছেন। স্ট্যাটাস্টি নিচে তুলে ধরা হল-
আমি আর আমার বন্ধু আসাদ রিকশার জন্য সূর্যসেন হলমুখী রোড থেকে রেজিস্ট্রার বিল্ডিং গেটের দিকে যাচ্ছি। ঠিক তখন সামনে থেকে আগত ১০-১২ জন ছেলে আমাদের পথ আটকায়। হকচকিয়ে গেলেও আমরা দাঁড়ালাম। প্রথমে একটা ছেলে ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে এসে জানতে চাইল আমরা এই ক্যাম্পাসের কিনা। বললাম, হ্যাঁ, আমরা দুজনই ক্যাম্পাসের।
আসাদকে তখন বলল কোন ইয়ার তুই? কোন হলে থাকিস্ত আমি বললাম আমরা অর্থনীতি ৩য় বর্ষের। ইভেন আমি আমার হল আইডি কার্ড দেখিয়ে বললাম ভদ্রভাবে কথা বল। কোনো তোয়াক্কা না করেই আবারও আসাদকে বলল তুই কোন হলের। আইডি কার্ড দেখা।
আসাদ পোলাইটলি জানতে চাইল তোমরা কোন ইয়ার, কোন হল, কেন চার্জ করছ এভাবে? তারা নিরুত্তর এবং মারমুখী ছিল তখন।
আসাদ আইডি কার্ড দেখানোর পর আইডি কার্ডটা দিয়েই ছেলেটা বলল, ‘প্রথম বর্ষের ছেলে কি তোরে চার্জ করতে পারে না? প্রথম বর্ষের পোলাপানের হাতে মাইর খাইতে খুব মজা লাগব’ বলেই ঠাস করে আসাদকে থাপ্পড় মারে।
আমি যখন জানতে চাই কি করলে এটা তখন বাকিরাও চড়াও হয় এবং আমাকেসহ হ্যারাস (নাজেহাল) করে ফেরাতে গেলে।
যখন আসাদকে এলোপাতাড়িভাবে মারতে থাকে, আমি আমার এক পরিচিত বন্ধুকে বলি আসতে। আমাদের অপরিচিত কয়েকটা ছেলে বাজেভাবে আক্রমণ করছে।
প্রশ্ন থাকতে পারে প্রক্ট্রিয়াল টিমকে কেন কল দিলাম না। প্রথমত আমার কাছে নাম্বার ছিল না। আর তারা তখনই খুব জোরে হেঁটে সূর্যসেন হলের গেটের ভেতরে চলে যায়।
আর আমরা ঘটনার আকস্মিকতায় মেন্টালি শকড ছিলাম। আসাদ তাদের পেছন পেছন হল গেটের ভেতরে গিয়ে যখন জানতে চাইল, ‘আমি এই ক্যাম্পাসের পরিচয় দেয়ার পর, আইডি কার্ড দেখানোর পরও আমাদের গায়ে কেন হাত তুললে তোমরা?’
তখন তারা মোটেই অনুতপ্ত না হয়ে বলছে- ‘তুই হলের ভেতরে আসলি কেন আবার?’ আসাদকে আবার মারতে আসে। তখন ওরা ১৫-২০ জন। অনেক মানুষই ছিল। মজা নিচ্ছিল, না ঘটনার আকস্মিকতায় তারাও চুপ- জানি না! আমি তখন আসাদকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার সময় ওরা গেস্টরুম থেকে স্ট্যাম্প, কাঠ নিয়ে আসে মারতে। আসাদের মাথায়, মুখে, কাঁধে, পায়ে সব শরীরে বাজেভাবে আঘাত করা হয়েছে।
আমি বাধা দিতে যাওয়ায় আমার গায়েও লাঠির আঘাত, তাদের জোরাজুরি আসাদকে আলাদাভাবে নিয়ে মারার জন্য। আমার পায়ে জুতা দিয়ে পিষে দেয়ায় আমার নখ উঠে গেছে। ব্লিডিং হচ্ছিল।
তখনও তারা থামে নাই। এফবিএস, সূর্যসেন ক্যাফেটারিয়া- এই তিন রাস্তার মোড়ে এসে আসাদের হলের কিছু পরিচিত মানুষ আসতে দেখায় তারা চলে যায়। কিন্তু ফিরে আবার মারমুখী হয়ে হুমকি দেয়।
আমরা দুজনেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। নিজের ক্যাম্পাসে এ রকম #শারীরিক #মানসিক #হ্যারেজমেন্ট #হামলার শিকার হব সেটি মেনে নেয়া অসম্ভব।
আজকে পরিচয়পত্র দেখানোর পর তাদের সিনিয়র জানার পরও হ্যারেজ করল।
আমার যে জুনিয়র বোন বা ভাই মাত্রই ক্যাম্পাসে আসল তাদের নিরাপত্তা কি তা হলে? আমার ক্যাম্পাসে আমি অতর্কিত হামলার শিকার হব কেন?
আমরা সূর্যসেন হলের প্রভোস্ট স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। স্যার আমাদের আগামীকাল লিখিত দিতে বলেছেন। প্রক্টোরিয়াল টিমও আমাদের ন্যায্য বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন এ পর্যন্ত। আমরা লিখিত দিব।
আসাদের শারীরিক অবস্থা তেমন ভালো না। আমার পায়ে ড্রেসিং করতে হয়েছে। মাথা আর ঘাড়ে প্রচন্ড ব্যথা।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের ঘটনায় সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আল ইমরান পলাশ, ইংলিশ ফর স্পিকারস অব আদার ল্যাঙ্গুয়েজেস (ইসোল) বিভাগের অর্পন, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজের সিফাতুল্লাহ নেতৃত্ব দেয় বলে জানা গেছে। তাদের নেতৃত্বে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের বেশ কয়েকজন হামলায় অংশ নেয়।
এ ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ২০ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।